রূপগঞ্জের চনপাড়া বস্তি যেন মাদক ব্যবসায়ীদের স্বর্গরাজ্য।
মাদকের অভয়াশ্রম হওয়ায় প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে কোটি টাকা মাদক। এই মাদক ব্যবসাকে ঘিরে তৈরী হচ্ছে সন্ত্র্যাসী, ঘটছে খুন জখমের ঘটনা। পুলিশের নাকের ডগায় মাদক ব্যবসা চললেও মাশোহারায় খেলনা ভূমিকায় পুলিশ।
নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার কায়েতপাড়া ইউনিয়ন অবস্থিত চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র। এলাকায় 'চনপাড়া বস্তি' নামে পরিচিত। লক্ষাধিক জনসংখ্যা নিয়ে গড়ে ওঠা বিশাল এলাকাটি।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর আরেকটি পরিচয় গড়ে উঠেছে। বলা হয়, মাদক কারবারি, খুন-রাহাজানি, ধর্ষণ, অপহরণ, চাঁদাবাজি, অজ্ঞান-মলম পার্টিসহ বিভিন্ন অপরাধীর আশ্রায়স্থল।
প্রকাশ্যে চনপাড়ার এই বস্তির অলিগলিতে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকের কেনাবেচা হয়।
অথচ পুলিশের ভুমিকা নিরব। অভিযোগ রয়েছে মাশোহারায় পুলিশকে ম্যানেজ করে চলে এই মাদকের বেচাকেনা।
গত (১১ নভেম্বর) র্যাবের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে সিটি শাহীনের মৃত্যুর পর ফের আলোচনায় আসে এই জনপদটি।
সন্ত্র্যাসী শাহিন ছিলেন ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং চনপাড়া মাদক নির্মূল কমিটির সদস্য সচিব। এলাকাবাসী বলেন, শাহিন একজন শীর্ষ সন্ত্র্যাসী যার নামে হত্যা মামলাসহ ২৩ টি মামলা রয়েছে সে কি করে রাজনীতি করে। যিনি রূপগঞ্জের বড় মাদক ব্যবসায়ী, অথচ মাদক নির্মূল কমিটির সদস্য সচিব ও সে।
শাহিন বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ রূপগঞ্জবাসী। তাদের হামলা ও নির্যাতনের ভয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস নেই কারও।
নাম না প্রকাশের শর্তে এক ব্যবসায়ী জানান, শাহীন ও তার দলবল মানুষের কাছে চাঁদা দাবী করত, চাঁদা না পেলে তাদের বাড়িতে লুটপাট চালাত। এমনকি ঘরের দামি আসবাব থেকে শুরু করে নগদ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যেত প্রকাশ্যে। অসহায় প্রতিবেশীদের নীরবে এসব দেখা ছাড়া প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগ ছিল না।
চনপাড়ার এই বস্তিটি বিশাল আয়তন হওয়ায় নিয়ন্ত্রকরা এটিকে নয়টি মহল্লায় ভাগ করেছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পাঁচ-ছয়টি গ্রুপ রয়েছে সেখানে। তবে বিভিন্ন সূত্র এবং স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, বস্তির প্রধান নিয়ন্ত্রক হলেন কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ড (চনপাড়া বস্তি এলাকা) মেম্বার এবং রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা বজলুর রহমান। সব মাদক কারবারির কাছ থেকে সাপ্তাহিক ও মাসিক হারে টাকা নেন তিনি। আর মাদকের এই বিপুল অর্থ তিনি প্রসাশনের কিছু অসাধু লোকসহ বিভিন্ন প্রভাবশালীদের কাছে বন্টন করেন।
এছাড়া একটি গ্রুপের হোতা জয়নাল আবেদিন ছিলেন বজলুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন। সব অপকর্মে তাঁকে ব্যবহার করতেন জয়নাল। এই মাদকের টাকার ভাগবাটোয়ায় শাহীনের প্রতিপক্ষ ছিলেন জয়নাল । প্রায় ছয়-সাত মাস আগে শাহীন গ্রুপ ও জয়নাল গ্রুপের মধ্যে মাদক কারবার ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারি হয়। এতে শাহীনের পক্ষের একজন মারা যায়। ওই মামলায় জয়নাল আবেদিন গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন। জয়নাল কারাগারে যাওয়ার পর শাহীনকে কাছে ডেকে নেন আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর রহমান। এরপর থেকে শাহীন আরও রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন। সম্প্রতি মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া বজলুর রহমান এখন জামিনে আছেন।
পুলিশ পরিদর্শক আশরাফুজ্জামান বলেন, চনপাড়া বস্তির তিন নম্বর এলাকার বালুর মাঠে মাদক কেনাবেচার খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে র্যাব-১-এর একটি দল অভিযানে যায়। র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক কারবারিরা র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। এক পর্যায়ে মাদক কারবারিরা পালিয়ে যায়। পরে দেখা যায়, সেখানে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শাহীন পড়ে আছে। তার পাশ থেকে একটি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলি ও ২০ গ্রাম হেরোইন পাওয়া গেছে। তাকে উদ্ধার করে ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। 'বন্দুকযুদ্ধে' শাহিন নিহত হওয়ার ঘটনায় গত শুক্রবার র্যাব-১-এর সিপিসি-১-এর পুলিশ পরিদর্শক আশরাফুজ্জামান বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় বলা হয়েছে, অজ্ঞাতপরিচয় মাদক কারবারিদের গুলিতে শাহীন নিহত হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ৩০-৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ মোমেন বলেন, শাহিন একজন শীর্ষ সন্ত্র্যাসী এমন কোন অপরাধ নাই যা সে করেনি। তাকে একাধিকবার গ্রেফতারের চেষ্টা চালিয়ে ছিল প্রসাশন। কিন্তু তারা সংঘবদ্ধ হওয়ায় শাহিনকে গ্রেফতার করা যায়নি। এর আগে তার লোকজন র্যাবের ওপর হামলা করেছিল। রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ এএফএম সায়েদ বলেন, গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে র্যাব চনপাড়া বস্তিতে অভিযান চালায় এ সময় শাহীন ও তাঁর লোকজন র্যাবের কয়েকজন সদস্যকে মারধর করে পালিয়ে যান। ওই ঘটনায় র্যাব-১-এর নায়েক সুবেদার তৌফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় মামলা করেন। এতে আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর রহমানসহ ৩১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। ওই মামলায় বজলু জামিন পেলেও তাঁর ছোট ভাই কারাগারে আছেন। বাকী আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
শাহীনের স্ত্রী রোকেয়া আক্তার ইতি গন মাধ্যমকে বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে শাহিন বাসা থেকে চনপাড়া দুই নম্বরে যাওয়ার কথা বলে চলে যান। বাসা থেকে বের হওয়ার পর গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। পরে দেখেন তার স্বামী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মারা যায়।
ইতির আরো বলেন, তাঁর স্বামী শাহিন মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। এ কারণে চনপাড়ার মাদক কারবারিরা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। এলাকার শমসের, শফিকুল, শাহ আলম ও সাহাবুদ্দিন মাদকের অন্যতম ডিলার। তাদের সঙ্গে শাহীনের দ্বন্দ্ব চলছিল।
উল্লেখ্য ১৯৭৪ সালে নারায়গঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের চনপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভূমিহীন মানুষদের ঠাঁই দিয়েছিলেন। বর্তমান এই জমির আয়তন ১২৬ একর জমি। যা ধীরে ধীরে চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রটি বস্তি হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে এই বস্তিতে লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। যে স্বপ্ন নিয়ে জাতির জনক আশ্রয় দিয়েছিলেন সেই আবাসস্থল এখন হয়েছে সন্ত্রাসীদের জনপদ। যদি চনপাড়ার এই বস্তি প্রশাসন কঠোরভাবে দমন না করতে পারে তাহলে দিন দিন এখানে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আতুর ঘর হয়ে উঠবে।
যোগাযোগের ঠিকানাঃ মোল্লা ব্রিজ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪। মোবাইলঃ ০১৯১৮-৪০৪৭৬০, বিজ্ঞাপনঃ ০১৭৩৩-৩৬১১৪৮