আন্তর্জাতিক ডেস্ক।।
সম্প্রতি ১০ জনেরও বেশি বাংলাদেশি সাংবাদিক প্রথমবারের মতো চীন সফরে আসেন। টেলিভিশন, সংবাদ ওয়েবসাইট, পত্রিকা, প্রকাশনা সংস্থা থেকে আসা পেশাদার এসব সাংবাদিক তাদের প্রথম সফরের জন্য উত্তর-পশ্চিম চীনের সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলকে বেছে নেন। তারা উত্তর সিনচিয়াংয়ের উরুমছির মসজিদে নামাজ পড়েন এবং দক্ষিণ সিনচিয়াংয়ের আকসুতে তুলা ক্ষেতে বেড়াতে যান। সাত দিনে তারা যা দেখেছেন ও শুনেছেন তা তাদের মুগ্ধ করেছে এবং অনুপ্রাণিত করেছে।
গোবি মরুভূমিতে "সবুজ গ্রেট ওয়াল"-
"চীন এতো বড় একটি দেশ! এ দেশে এতো জায়গা আছে যে, মরুভূমি অঞ্চল থেকে মানুষকে সহজেই অন্য স্থানে নেওয়া যায়। কিন্তু সেটা না করে, এ জাগয়াটি উর্বর করে তোলা, এখানে বিনিয়োগ করা, একে বসবাযোগ্য করে তোলা, একে জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করা অসাধারণ একটি কাজ।” কেকেয়া মেমোরিয়াল হলে, মরুভূমি বনে পরিণত হওয়া ও গোবির বাগানে পরিণত হওয়ার স্থানীয় বালি নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস জানার পর, বাংলাদেশের আরটিভি চ্যানেলের সংবাদ ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের নির্বাহী প্রযোজক বেলায়েত হোসেইন লিফটে এমন মন্তব্য করেন।
১৯৮৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কেকেয়ার মরুভূমির ৮০.২ হাজার হেক্টর ভূমিতে কৃত্রিম বন সৃষ্টি করা হয়। ‘মুত্যুর সমুদ্র’ নামে পরিচিত তাকলামাকান মরুভূমির উত্তর দিকে একটি ‘সবুজ গ্রেটওয়াল’ গড়ে ওঠে এবং মরুভূমির বালুঝড়ের ক্ষতিও অনেক কমে যায়।
তাকলামাকান মরুভূমির উত্তর দিকে "সবুজ গ্রেটওয়াল" দেখে বেলায়েত হোসেইন খুব মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি বলেন, চীনের জনগণের কঠোর পরিশ্রম ও সংগ্রাম এবং দেশ পরিচালনায় সরকারের দৃঢ় সংকল্প ও সাহস প্রশংসনীয়। "আমি মনে করি, এ রকম জায়গাগুলোকেও উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করার যে মডেলটা আমি এখানে দেখলাম, এটা বাংলাদেশসহ যে দেশগুলো দ্রুত উন্নতির চেষ্টা করছে, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছে, তাদের জন্য একটি ভালোমডেল হতে পারে।“
"চীনের তুলার রাজধানী" দক্ষিণ এশীয় অতিথিদের একটি আলোচ্য বিষয় ছিল সবুজ সমুদ্রের তুলা। সিনচিয়াং-এর আকসু অঞ্চল "চীনের তুলার রাজধানী" হিসাবে পরিচিত এবং এটি চীনের জাতীয় উচ্চ মানের তুলা উৎপাদনের ভিত্তি। চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরী পোশাক রপ্তানিকারক দেশ এবং বাংলাদেশের রফতানি মূল্যের ৮০ শতাংশ আসে তৈরী পোশাক শিল্প থেকে।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের চীনবিরোধী শক্তিগুলি "সিনচিয়াং-এ উইঘুর জনগণের বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও “জোরপূর্বক শ্রম" আদায়ের মতো মিথ্যা অভিযোগ তুলে আসছে। আকসুতে তুলার ক্ষেত এবং টেক্সটাইল মিল পরিদর্শন করার পর, বাংলাদেশি মিডিয়ার লোকেরা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছান। বাংলাদেশ এডোর্ন প্রকাশনার প্রকাশক সৈয়দ জাকির হোসাইন একটি মোজা উৎপাদন কারখানা পরিদর্শন করার পর বলেন: "এখানকার পরিবেশ দেখে মনে হয় না যে, কোনো শ্রমিকের ওপর কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে আমি যে কথাটা বলবো, সেটি হচ্ছে, তারা এখানে আসুক। তুলার যে রাজনীতি চলছে, তা নিজ চোখে দেখুক। শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ সুন্দর, যা এখানে এলেই দেখা যাবে।"
আকসুতে মুসলমানদের সাথে নামাজ পড়ার চমৎকার অভিজ্ঞতা। সিনচিয়াংয়ে এক সপ্তাহ থাকাকালে বাংলাদেশি সাংবাদিকরা দুটি মসজিদ পরিদর্শন করেন: আকসু রেস্তগামা মসজিদ এবং উরুমছির নানদা মসজিদ। বাংলাদেশ জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত " জনসংখ্যা ও আবাসন শুমারি ২০২২"-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬.৫১৫ কোটি, এবং এখানে ৯১.০৪% মুসলমান।
"একজন ধর্মবিশ্বাসী হিসেবে এ মসজিদে এসে আমার এক অসাধারণ অনুভূতি হয়েছে। নিজের মধ্যে একটা পবিত্রতার জাগরণ আমি অনুভব করলাম।" বাংলাদেশের জাগোনিউজ.২৪ ওয়েবসাইটের উপ-সম্পাদক ডক্টর হারুন রশিদ আকসু’র রেস্তগামা মসজিদে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, “ইমাম সাহেব নামাজ শেষে স্থানীয় ধর্মবিশ্বাসীদের উদ্দেশ্যে বয়ান করেন এবং তিনি কোথা থেকে বেতন পান, তার আর্থিক সামাজিক এবং পারিবারিক কী অবস্থা সেটিও আমরা জানতে পেরেছি। তাঁর বয়স মাত্র ৩৪ বছর এবং তিনি অতন্ত দক্ষতার সঙ্গে আমাদেরকে পবিত্র কোরআন থেকে তেলওয়াত করে শুনালেন, যেটি আমাদের অনেকটা মুগ্ধ করেছে।”
রেস্তগামা মসজিদে নামাজ পড়ার পর বাংলাদেশের ‘দৈনিক সময়ের আলো’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আলমগীর রেজা চৌধুরী আবেগপূর্ণ হয়ে বলেন, "পশ্চিমা বিশ্ব অনেক অপপ্রচার করেছে। আমি আকসুতে মসজিদে নামাজ পড়েছি। একজন মুসলিম হিসাবে আমি অসম্ভব রকমের আন্তরিকতার প্রকাশ পেয়েছি এখানে।"
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সিনচিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের জনসংখ্যা ১.৪৪ কোটি, যার মধ্যে ৫৩.৩ শতাংশ মুসলমান। সিনচিয়াংয়ে বর্তমানে মোট ২৪ হাজার ৪০০টি মসজিদ রয়েছে। অন্যভাবে বললে, এখানে গড়ে প্রতি ৫৩০ জন মুসলমানের জন্য একটি মসজিদ আছে।
জীবন রক্ষার মতো জাতীয় ঐক্য রক্ষা করা
সিনচিয়াংয়ে মোট ৫৬টি জাতির বাস। বাংলাদেশও একটি বহু-জাতির দেশ। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৯ বাঙালি এবং সেখানে ৪৫টি সংখ্যালঘু জাতির মানুষও পাশাপাশি শান্তিতে বসবাস করছে। সিনচিয়াং ভ্রমণের সময়, থিয়ানশান থিয়ানছি সিনিক এলাকার কাজাখ জাতিগত কাস্টমস গার্ডেনে হোক বা আকসু অঞ্চলের আওয়াথি জেলার দাওলাং জনগোষ্ঠী হোক, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমৃদ্ধ এবং বর্ণিল সংস্কৃতি, শিল্প ও রীতিনীতি বাংলাদেশি সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
"বাংলাদেশ পোস্ট"-এর বিশেষ প্রতিবেদক আরিফুল ইসলাম বলেন, "চীনে একটি নীতি আছে, ৫৬টি জাতির সবাইকে একত্রিত রাখতে হবে এবং সকলকে তার তার ধর্ম, তার তার জায়গা, তার তার বর্ণের জন্য লড়াই করতে দিতে হবে। জীবনকে যেভাবে রক্ষা করা হয়, সেভাবে জাতীয় ঐক্য রক্ষা করতে হবে। এটি একটি খুব ভালো দিক। আমি সফরের সময় দেখতে পেরেছি, জাতিতে জাতিতে পার্থক্য তেমন একটা নেই; আমার কাছে সবাইকে একটি ইউনিট মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন তারা সবাই এক জাতি। এটা আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে।"
বাংলাদেশের "দৈনিক সময়ের আলো” পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আলমগীর রেজা চৌধুরীর বয়স ৬৯ বছর। দওলাং জনগোষ্ঠীর গেটের সামনে, তিনি স্থানীয় মানুষের সাথে নাচলেন এবং অনন্য স্থানীয় সংস্কৃতি ও রীতিনীতি উপভোগ করলেন। "আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছে যে আমরা ভালো আছি। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের যা দরকার, সেটা কিন্তু আমরা লালন করি। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ, গোষ্ঠীর মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, টোটেম ও তাবুগুলো সংরক্ষিত আছে। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ আছে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বি আছে কিন্তু তারা তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এটা কিন্তু বড় ব্যাপার। এটি একটি দেশের নির্মাণ ও উন্নয়নের পথে বড় অর্জন, যা একটি সহাবস্থানের রাষ্ট্র এবং একটি দেশের উন্নয়নের ভিত্তি।"
জনাব আলমগীর রেজা চৌধুরী চীনের সুবিখ্যাত লেখক লু স্যুন-এর কবিতার বাংলা অনুবাদক। এ জন্য উরুমছিতে লু স্যুন-এর মূর্তিটি দেখে তিনি খুব উত্তেজিত বোধ করেন। "লু স্যুনের কবিতার বইয়ের পঞ্চম সংস্করণ বের হয়েছে। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহলেও ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। তবে, লু স্যুনের বর্ণিত চীন বর্তমান চীন থেকে অনেক আলাদা। চীন সামনে এগিয়েছে। আধুনিক চীনকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে চীনা সংবাদমাধ্যম আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।"
এবার সিনচিয়াং সফরের পর বাংলাদেশি সাংবাদিক প্রতিনিধিরা বলেছেন যে, সাত দিনের সফরটি তাদের জন্য অবিস্মরণীয় ছিল এবং তারা যা দেখেছেন ও শুনেছেন তা আরও বাংলাদেশি বন্ধুকে জানাবেন। একই সঙ্গে তারা আশা করেন, ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগ দুই দেশের মধ্যে আরও সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করবে।
যোগাযোগের ঠিকানাঃ মোল্লা ব্রিজ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪। মোবাইলঃ ০১৯১৮-৪০৪৭৬০, বিজ্ঞাপনঃ ০১৭৩৩-৩৬১১৪৮